বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কি, কিভাবে রিজার্ভ গঠিত হয় এবং কোথায় কোথায় তা ব্যবহার করা যায়?

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কি, কিভাবে রিজার্ভ গঠিত হয় এবং কোথায় কোথায় তা ব্যবহার করা যায়?

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কি?

রিজার্ভ সম্পর্কে নানাহ প্রশ্ন আজ গ্রামে, গন্জে, শহর-বন্দর সর্বত্র। আর এর মূল কারণ বর্তমান অর্থনৈতীক পরিস্থিতি। তাই সাধারণ মানূষও প্রধান মন্ত্রির দিকে আঙ্গুল উঠিয়ে জিজ্ঘাসা করছে রিজার্ভের টাকা কোথায় গেল? উত্তরে যা পাওয়াযাচ্ছে তা সন্তুষজনক নয় বিধায় আমি এই সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

রিজার্ভ মানে সন্চিতি। সুতরাং বৈদেশিক মূদ্রার সন্চিতি (রিজার্ভ) মানে হল কোন দেশের রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশে বা সংস্থা থেকে পাওয়া ঋণ বা অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ (-) বিয়োগ বৈদেশিক মূদ্রার খরচ; যেমন আমদানি, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা, পর্যটন বা বিদেশে শিক্ষা ইত্যাদি খাতে খরচ হয়।

আন্তর্জাতিক লেনদেনে মুদ্রার ভিন্নতা একটি বড় সমস্যা হয়ে যায়। এই সমস্যা দূর করতে আগেকার দিনে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যাবহার করা হত সোনা (অথবা রুপা)। এবং সোনা ছিল আন্তর্জাতিক লেনদেনের সাধারণ মুদ্রা। কোন দেশ পণ্য রপ্তানি করলে সেই দেশের কোষাগারে স্বর্ণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। আবার আমদানি করার সময় কোষাগারে থেকে স্বর্ণের পরিমাণ হ্রাস পেত। অর্থাৎ, স্বর্ণই ছিল মুদ্রা। আর বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রার মান স্বর্ণের বিপরীতে নির্ধারিত হত। এভাবেই চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কি? কিভাবে রিজার্ভ গঠিত হয় এবং কোথায় কোথায় তা ব্যবহার করা যায়?
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কি? কিভাবে রিজার্ভ গঠিত হয় এবং কোথায় কোথায় তা ব্যবহার করা যায়?

 

কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপীয় দেশ গুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঋণী হয়ে প্রচুর স্বর্ণ হারিয়ে ফেলে। ফলে তাদের দ্বারা আর দেশীয় মূদ্রার বিপরীতে সোনা মজুদ করে রাখা সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তির মধ্যে দিয়ে নতুন নিয়ম জারি করা হল, একমাত্র মার্কিন ডলারের বিপরীতে সোনা মজুদ থাকবে, এবং ৩৫ ডলারে এক আউন্স। বাদবাকি সকল মুদ্রা ডলারের সাথে সামাঞ্জস্য বজায় রাখবে। এইভাবে মার্কিন ডলার হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাধারণ মুদ্রা।

পরবর্তীতে আমেরিকা তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে চুক্তির উল্লিখিত পরিমাণের অতিরিক্ত ডলার ছাপাতে থাকে। এই ব্যাপারে অভিযোগ উঠলে ১৯৭১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ডলারের বিপরীতে সোনার মজুদ ব্যাবস্থা বাতিল ঘোষণা করে। এইভাবে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড এর ইতি ঘটে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ভাবে বনিজ্যের জন্যে একটি সাধারণ মুদ্রা প্রয়োজন, যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। বর্তমানে সেই গ্রহণযোগ্য সাধারণ মুদ্রার রাজ-আসন ব্রেটন উডস এর কল্যাণে ঐতিহাসিক ভাবেই দখল করে আছে মার্কিন ডলার।

একটি পরিবারের আয় অপেক্ষা ব্যয় কম হলে যেমন সঞ্চয় বৃদ্ধি পায় ঠিক তেমনি একটি রাষ্ট্রের ডলার আয় অপেক্ষা ব্যয় কম হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়। আর এই সঞ্চয়কেই ইংরেজিতে বলে রিজার্ভ। অনেক সময় একে ফরেক্স রিজার্ভও বলা হয়ে থাকে। ফরেক্স শব্দের অর্থ হচ্ছে ফরেইন এক্সচেঞ্জ বা বৈদেশিক লেনদেন। যেহেতু আমরা বৈদেশিক লেনদেনের মাধ্যমে এই সঞ্চয় বা রিজার্ভ অর্জন করি তাই একে বলি ফরেক্স রিজার্ভ (Foreign Exchange Reserve)।

রিজার্ভ যে সবসময় ডলারেই থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে ডলার বিক্রয় করে ইউরো, ইয়েন বা স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি কিনে রাখতে পারে। এই সকল সম্পদের সম্মিলিত বাজার দরের পরিমাণই হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ।

হিসাব বিজ্ঘানের দৃষ্টিতে রিজার্ভ হলো কোন একটি দেশের ডলার (usd) হিসাবের ব্যালেন্স বা সারপ্লাস। সুতরাং ইহা ক্যাশবুকের মতই সংরক্ষন করা হয়। পূর্বের ব্যালেন্সের সাথে বর্তমান সময়ের মোট ডলার ইনকাম মাইনাস মোট ডলার খরচ। তবে ক্যাশবুকের মতো সংরক্ষন করা হলেও রিজার্ভের ডলার খরচ করার ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হয়, কারন তা আন্তর্জাতিক মানদন্ড ও বিশ্ব ব্যাংকের কড়া নজরদারীর মধ্যে থাকে।

Previous Balance + USD Income – USD Expenses = Reserve (Surplus)of foreign currency)

লোকাল কারেন্সি রিজার্ভ

কোনো একটি দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আমানত হিসাবে নেয়া মোট অর্থের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়, এটাকে বলে রিজার্ভ। আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হইল বাংলাদেশ ব্যাংক। এই অর্থ তারা ঋণ বা অন্য কোন কাজে খরচ করতে পারে না এবং গ্যারান্টি হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা থাকবে। আবার ক্রেডিট রেটিং বিহীন যে পরিমাণ লোন প্রদান করা হয়েছে তার উপরও ২% হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। এই সমুদয় টাকা লোকাল কারেন্সি হিসাবে রিজার্ভ থাকে। কোম্পানীর ব্যালেন্সসিটেও রিজার্ভ দেখা যায়, বিষেশকরে যখন ব্যাংকে প্রদান করা হয়। ঐ রিজার্ভ প্রফিট থেকে নিয়ে গঠন করা হয় এবং তা ব্যবসায়ের স্ট্রেংথ নির্দেশ করে।

কিভাবে রিজার্ভ গঠিত হয়?

প্রধানত আমদানী ও রপ্তাণীর পার্থক্য থেকে রিজার্ভ গঠিত হয়। যদি প্রচুর পরিমান রপ্তানী থাকে এবং সেই তুলনায় আমদানী কম থাকে তাহলে এই দুইয়ের পার্থক্যই হল রিজার্ভ। বাংলাদেরশ রিজার্ভ কত তা জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে পাকিস্থান সরকার কত রিজার্ভ রেখেগিয়েছিল। ধরে নেই তার পরিমাণ ছিল (ক)। এর পর থেকে এই পর্যন্ত মোট কত ডলার বা তার সমমান আয় হয়েছে, ধরি তা হলো (খ)। অতপরঃ এই পর্যন্ত কত ডলার বা তার সমপরিমাণ ব্যয় হয়েছে, ধরুন তাহলো (গ)। অবএব, বাংলাদেশের রিজার্ভ হবে, ক+খ-গ  ডলার।

রিজার্ভের ডলার কোথায় ও কিভাবে খরচ করা যায়?

এভাবে গচ্ছিত বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল কোথায় ও কিভাবে ব্যবহার করা হয় তা আলোচনা করা হইলঃ 

০১। বিজ্ঙদের মতে, গচ্ছিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রধানত আমদানি মূল্য এবং বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ, ইত্যাদি পরিশোধে ব্যবহৃত হয়। টাকা ব্যতিত অন্য কোন কারেন্সিতে বৈদেশিক ব্যায় মিটাইবার জন্য রিজার্ভের ডলার খরচ করাই প্রধান লক্ষ্য। উদাহরণ স্বরুপ আমদানী ব্যয়, বিদেগামী ও বিদেশে অধ্যয়নরত ছাত্রদের খরচ মেটানো, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী দূতাবাসে কর্মরত ব্যাক্তিদের খরচ প্রদান, বিদেশী কোন প্রতিষ্ঠানের দায়-দেনা মেটানো ইত্যাদি। দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে করমরত ঠিকাদারদের পাওনা পরিশোধেও বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়। এর বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চাঁদা দেয় বাংলাদেশ। রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি লিখিত নির্দেশনা আছে, যাকে সব দেশই মেনে চলতে হয় ।

০২। মূদ্রস্ফিতি প্রতিরোধ করা হলো রিজার্ভের ডলার খরচ করার দ্বিতীয় খাত। প্রথমে মূদ্রা স্ফিতির পরিমাণ নির্ণয় করতঃ সমমূল্যের ডলার কিংবা গোল্ড বিক্রয় করে দিয়ে মার্কেট থেকে টাকাগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে। এতে মূদ্রাস্ফিতি নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে সমপরিমাণ টাকা জমা হইবে। উক্ত টাকা দিয়ে স্বর্ন কিংবা অন্য কিছু কিনে তাকে ব্লক করে রাখতে হবে।

০৩। হঠাৎ কোন প্রাকৃতীক দূর্যোগ হলে সাময়িকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য রিজার্ভ ব্যবহার করা যাইতে পারে; তবে অবশ্যই এমনখাতে খরচ করতে হবে যেন তা আদায়যোগ্য হয়। যদি আদায়ের সম্ভাবনা না থাকে তবে এমন খাতে কখনোই খরচ করা যাবে না।

অর্থনীতির তত্ন

অর্থনীতির তত্ত্বে বলা হয়, একটা দেশের তিনমাসের আমদানির খরচের সমমানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবশ্যই থাকতে হবে। বাংলাদেশের তিন মাসের আমদানী ব্যায় প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার-১৯৭২ অনুযায়ী, রিজার্ভ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ অন্য দেশের নানা ধরনের সরকারি পেপারে বা ঝুঁকিহীন উচ্চ ঋণমানের সার্বভৌম বন্ডে বিনিয়োগ করে। আবার কিছু অংশ দিয়ে স্বর্ণ কিনে রাখে।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬২৩ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১০ কোটি টাকা) অর্থ চুরি হয়েছিল। এই ডলারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের একাউন্ট বা ভল্ট থেকে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশের রিজার্ভ ডলার থেকেই হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে জালিয়াতি করে নিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যূনতম বাজার ঝুঁকিতে সর্বোচ্চ স্বল্পমেয়াদি রিটার্ন নিশ্চিত করতে রিজার্ভ সম্পর্কিত বিনিয়োগের সিদ্ধান্তগুলো সাবধানতার সঙ্গে গ্রহণ করে।

যথেষ্ট পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা থাকলে সেখান থেকে সরকার, অন্য কোনো দেশ বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সুদে ঋণ দিতে পারে যা অবশ্যই বৈদেশিক মুদ্রায় ফেরত দিতে হবে। তাহলে এতে মুনাফাও অর্জন হবে আবার কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। উল্ল্যেখ্য যে, বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে ২০১০ সালে ১০০ কোটি ডলারের প্রথম ঋণচুক্তি সই করেছিল ভারত। এরপর আরও তিন দফায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ৭০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই করে। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর জন্য প্রায় ১৪ কোটি ডলার ভারত মঞ্জুরি হিসেবে দিয়েছে।

গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ডলার উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করার ক্ষেত্রে অনেক ঝুঁকি আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবশ্যই আমাদের জন্য আশীর্বাদ। রিজার্ভের অর্থ সব জায়গায় বা সব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় না। এর জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন আছে যেগুলো দৃঢ়তার সাথে মেনে না চললে বিপদও হতে পারে। সে জন্য দুর্নীতি ও অর্থপাচার রুখতে হবে, অর্থনৈতিক সুশাসন, আইনের শাসন এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
_______________

(Visited 45 times, 1 visits today)

Leave a Comment